প্রয়াত নিরীহ মনমোহন কথা কম কাজ বেশী করতেন ৷ কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ছিলেন ৷
নয়াদিল্লি: বাড়ির উঠোনে বসে পড়াশোনা করছিল ছেলেটি। ওই উঠোনেরই এক কোণে গোবর-মোষের পরিচর্যা করছিলেন বাবা গুরমুখ সিং। কাজ করতে করতেই ডাক দিলেন, ‘মোহনা. . . ! গোবর-ছোঁনা মেখে রাখা বালতিটা আমার কাছে এনে দে তো।’ বইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে থাকা ছেলেটির কানে পৌঁছায়নি বাবার ডাক। তিন-চারবার ডাকের পরেও বইয়ের পাতা থেকে চোখ তোলেনি সেই বালক। শেষমেশ সুস্পষ্ট পাঞ্জাবি ভাষায় ক্ষুব্ধ হয়ে গুরমুখ সিং ছেলেকে বলেছিলেন, ‘কী এত পড়াশোনা করছিস? বড় হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবি নাকি? ’ গুরমুখ সিং জানতেন না, তাঁর এই ছেলে সত্যিই একদিন প্রধানমন্ত্রী হবে। কেবল তাই নয়, সেই ‘মোহনা’ ভারতীয় অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেবে।
![]() |
প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। |
প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
প্রকৃত সংস্কারক হয়ে উঠবে। নতুন যুগের সূচনা করবে। কিন্তু, থাকবে না তাঁর কোন মার্কেটিং প্যাকেজ। নিঃশব্দে কাজ করতে থাকবে। লো-প্রোফাইল, সেই ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ এই বিশ্ব ত্যাগও করলেন প্রচারের বাইরে থেকেই। রাত ৮টা সময় শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হলেন দিল্লি এমসে। এবং রাত্রি ১০টা ৫০ নাগাদ মিনিটে জানা গেল, প্রয়াত মনমোহন সিং। সূত্রের খবর, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে ৭ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করবে কেন্দ্র। আজ, শুক্রবার পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ (বর্তমানে পাকিস্তানে পাঞ্জাব একটি অংশ ) । সেখানকারই গাহ গ্রামে জন্ম হয়েছিল মনমোহন সিংয়ের। ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। দেশভাগের পর চলে আসেন ভারতে। ১৯৫৪ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এবং তার তিন বছর পর লন্ডনের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর। একের পর এক পালক এরপর জুড়েছে তাঁর মুকুটে। ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড থেকে ডি ফিল। তখনই তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করে দেন।
১৯৬৬ থেকে ’৬৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের হয়ে কাজ। এবং সাতের দশকের শুরুতে দেশে ফিরে দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে অধ্যাপনা শুরু। পড়াতেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। ‘হীরে’ চিনতে ভুল হয়নি ইন্দিরা-ঘনিষ্ঠ সাংসদ তথা বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী ললিত নারায়ণ মিশ্রের। তিনিই মন্ত্রকের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করেন মনমোহনকে।
তারপর একে একে অর্থমন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অর্থ সচিব এবং যোজনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালেই ইন্দিরা সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন। মেয়াদ শেষে মনমোহন চলে যান সুইজারল্যান্ড।
যোগ দেন জেনিভার ইকনমিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল পদে। দেশে ফেরেন ১৯৯০-এর নভেম্বরে। প্রথমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, এবং তারপরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। গল্পের মোড় ওই বছরেরই জুন মাসে। প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। বললেন, ‘আপনাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে হবে।’ ভারত বোধহয় ওই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিল। জন্ম নিল রাও-মনমোহন মডেল। দেশে প্রবেশ করল উদার অর্থনীতি। সেই ছিল নতুন ভারত।
মনমোহন কথা কম কাজ বেশী করতেন ৷
বাজপেয়ি জমানার অবসানের পর ইউপিএ যখন ক্ষমতায় এল, রাজনৈতিক মহল সোনিয়া গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের বিষয়ে নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু না। সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে ঘোষণা হয়েছিল মনমোহনের নাম। ২০০৪ থেকে ’১৪—দশ বছর দেশের প্রশাসনিক প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। এবং সেইসঙ্গে ভারত দেখেছে একের পর এক সামাজিক সংস্কার। তথ্য জানার অধিকার আইন, ১০০ দিনের কাজ, শিক্ষার অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা বিল. . . মনমোহন জমানায় জনমোহিনী পদক্ষেপ ছিল সীমাহীন। কৃষিঋণ মকুব করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি, ফুসফুসের সংক্রমণে ভর্তি ছিলেন দিল্লির হাসপাতালে
বিশ্বজুড়ে চরম মন্দার সময়ও আগলে রেখেছেন দেশের অর্থনীতিকে। অনড় অবস্থান বজায় রেখে পরমাণু চুক্তিও সম্পন্ন করেন মনমোহন সিং। সংসদীয় রাজনীতিতে বরাবরই তিনি ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে অবসর নেন এই পদ্মবিভূষণ ব্যক্তিত্ব। শীর্ষপদে থাকাকালীন বহুবার অসম্মানিত হয়েছেন। শুনতে হয়েছে ‘সোনিয়ার পুতুল’ অথবা "মৌন মোহন"-এর মতো কটাক্ষ। তাও সৌজন্যের গণ্ডি ছাড়াননি তিনি। ৯২ বছর বয়সে. . . শেষদিন পর্যন্তও না। ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর বলেছিলেন ‘আজ আমাকে মিডিয়া সুবিচার দেয়নি। একদিন ইতিহাস নিশ্চয়ই দেবে। বিশ্বাস ছিল তাঁর ইতিহাসে। এবং ইতিহাসের? মনমোহন সিংয়ের কর্মকাণ্ডে।
![]() |
BREAKING NEWS TODAY'S |
আপডেট পেতে, আমাদের সাথেই থাকুন ! পাশে থাকুন ৷ খবরের সাথেই থাকুন ! Breaking News Todays সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি: Facebook, Facebook page, Whatsapp Group.
0 মন্তব্যসমূহ